বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । পাকিস্তানের সামরিক শাসক যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের ওপর একের পর এক নিপীড়নমূলক আচরণ করে, তখনই এদেশের জনগণ তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে । যার পরিণতি ছিল ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান । এ অভ্যুত্থানে ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করলে তার উত্তরসূরি জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেন । তিনি ঘোষণা করেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে । যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করে । একপর্যায়ে তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করে এবং শেষ পর্যায়ে এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর নির্দেশে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ শত্রুর দখলমুক্ত হয়।
এই অধ্যায় শেষে আমরা-
১৬৭
১৯৮
২৬৭
২৯৮
ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে ১৯৭০ সালের ২৬শে মার্চ এক বেতার ভাষণে পরবর্তী নির্বাচন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে পুনরায় রাজনৈতিক তৎপরতার অনুমতি দেওয়া হয় । পাশাপাশি ৫ই অক্টোবর জাতীয় পরিষদ ও ২২শে অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা পিছিয়ে ৭ই ডিসেম্বর এবং ১৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় । তবে ১২ই নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হওয়ায় ঐ সব অঞ্চলে ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ২৮শে মার্চ জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে নির্বাচন সংক্রান্ত আইনগত কাঠামো আদেশ ঘোষণা করেন । সেখানে তিনি মূলত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য সংখ্যা কত হবে, ভোটদানের প্রক্রিয়া কী হবে, কত দিনের মধ্যে নির্বাচিত পরিষদ সংবিধান রচনা করবে এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য বিশেষ কিছু দিক তুলে ধরেন ।
তার ঘোষণার বিশেষ দিকগুলো ছিল :
অঞ্চল | জাতীয় পরিষদ | প্রাদেশিক পরিষদ | ||||
সাধারণ | মহিলা | মোট | সাধারণ | মহিলা | মোট | |
পূর্ব পাকিস্তান | ১৬২ | ৭ | ১৬৯ | ৩০০ | ১০ | ৩১০ |
পশ্চিম পাকিস্তান | ১৩৮ | ৬ | ১৪৪ | ৩০০ | ১১ | ৩১১ |
আইনগত কাঠামো আদেশের ২০ নং ধারায় সংবিধানের মূল ছয়টি নীতি বেঁধে দেয়া হয় । যথা :
ক. ফেডারেল পদ্ধতির সরকার;
খ. ইসলামি আদর্শ হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি;
গ. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন;
ঘ. মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে;
ঙ. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিভিন্ন এলাকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূর করতে হবে;
চ. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে ।
ইয়াহিয়া খানের আইনগত কাঠামো আদেশে মূলত সার্বভৌম পার্লামেন্টের বদলে একটি দুর্বল পার্লামেন্টের রূপরেখা দেওয়া হয় । ফলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো এর সমালোচনা করে। তারা এ আদেশের অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহ বাদ দেওয়ার দাবি জানায় ।
১৯৬৯ সালের ২রা জুলাই ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা অনুযায়ী পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এ নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক কাজ ছিল একটি সর্বজনীন ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা । এ তালিকার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩,১২, ১৪,৯৩৫ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ২,৫২,০৬,২৬৩ জন । এ ভোটার তালিকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল:
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সমমনা দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেও আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এককভাবে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো পৃথক পৃথকভাবে প্রার্থী মনোনীত করে । মোট ৭৮১ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন । জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের ছিল ১৭০ জন প্রার্থী এবং তাদের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), নিখিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় জমিয়াতুল উলেমা ও নেজামে ইসলাম, ইসলামী গণতন্ত্রী দল, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন), পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) প্রভৃতি ।
নির্বাচনের ফলাফল:
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে । সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগ মোট ১৬৭টি আসন লাভ করে জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে । আবার পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ মোট ২৯৮টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে । সে সময় জাতীয় পরিষদের সদস্যদের এমএনএ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের এমপিএ বলা হতো । ভোটের ফলাফল মূল্যায়নে দেখা যায়, মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ৭৫.১০% এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৭০.৪৮% ভোট পায় । নির্বাচনের এমন ফলাফল পূর্ব পাকিস্তানকে একটি পৃথক অঞ্চল এবং বাঙালি জাতিকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় এ দলের নেতৃত্বে সরকার গঠন হওয়া ছিল আইনসম্মত। কিন্তু, পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি আরম্ভ করেন। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনায় ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করেন । এ ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । বিভিন্ন স্থানে জনতা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে । সারাদেশে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে বহু লোক নিহত ও আহত হয়। ঐদিন ছাত্রলীগের নেতারা 'স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করেন। এ সংগঠনের উদ্যোগে ২রা মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট আহ্বান করা হয় । এদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক ছাত্র সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩রা মার্চ ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সেখানে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । সমাবেশে ছাত্রলীগ ৫ দফা প্রস্তাব গ্রহণ করে যা স্বাধীনতার ইশতেহার নামে চিহ্নিত করা হয় । এতে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয় । এছাড়া ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন অর্ধবেলা হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হয় ।
ছাত্রদের এ ইশতেহারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা আপামর জনসাধারণ সক্রিয়ভাবে হরতাল পালন করে । ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন শিল্পীরা অনুষ্ঠান বর্জন করেন। ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবীরা তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করে আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন । এ তিন দিনের হরতালে ঢাকাসহ সমগ্র দেশে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে । বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে বহু লোক আহত ও নিহত হয়। ইয়াহিয়া খান এ পরিস্থিতিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে অগত্যা ৬ই মার্চ বেতার ভাষণে ২৫শে মার্চ পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন । তবে তার ঘোষণা বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সে ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারেননি। ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সামরিক শাসনবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনসভার আয়োজন করা হয় ।
নির্বাচনের গুরুত্ব:
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক । ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের পর এটিই ছিল সবচেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ একমাত্র জাতীয় নির্বাচন । ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাঙালি জাতি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে যে স্বাতন্ত্র্য দাবি করে আসছিল, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার বিজয় অর্জিত হয় । এছাড়া পূর্বাঞ্চলের জনগণ স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি করে আসছিল তা পশ্চিমাঞ্চলের সরকার অবৈধ বলে ঘোষণা করে । এ নির্বাচনের ফলাফলে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণিত হয়। সর্বোপরি ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এলে তিনি তা না করে নিরীহ বাঙালির ওপর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেন । শুরু হয় বাংলার মানুষের মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয় ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সামরিক সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় । সারা দেশে নানারকম উদ্বেগ, উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল জাতির জন্য সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা । পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল নামে । বঙ্গবন্ধু এ সমাবেশে যে ভাষণ দেন তা বিশ্বের ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছে। ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে চারটি দাবী উপস্থাপন করেন। এগুলো হলো:
এর বাইরে আরও বেশ কিছু দাবি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উত্থাপন করা হয়। তিনি বাংলাদেশের সকল অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়াবো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।' তিনি মুক্তি সংগ্রামের জন্য সকলকে প্রস্তুত হওয়ার আদেশও দেন এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানান । তাঁর এ ভাষণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বজ্রকণ্ঠ' নামে প্রচারিত হয়, যা বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করে।
২০১৭ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ'কে বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা, ইউনেসকো (UNESCO) । ভাষণটি ইউনেসকো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য 'Memory of the World International Heritage Register'-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ পর্যন্ত এসব স্বীকৃতির মধ্যে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকেই প্রথম পাণ্ডুলিপিবিহীন এবং অলিখিত ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পরদিন থেকে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়ে যায় । তাঁর নির্দেশ অনুসারে দেশের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কল-কারখানা সব বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ করতে থাকে । খাজনা-ট্যাক্স আদায় বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করেন। ১০ই মার্চ সরকার এক সামরিক আদেশ জারি করে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কর্মস্থলে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এর পরও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৩ই মার্চ সরকার পুনরায় সামরিক আইন জারি করে । ১৪ই মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি অবাস্তব প্রস্তাবের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ফর্মুলা দেন। তবে বঙ্গবন্ধু এসব কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ঐ দিনই ৩৫ দফাভিত্তিক দাবিনামা জারি করেন। সেখানে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনসাধারণকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়া হয় ।
বঙ্গবন্ধুর আদেশ জারির পর থেকে শুধু ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত । অবস্থার গভীরতা উপলব্ধি করে ইয়াহিয়া খান ১৫ই মার্চ ঢাকা সফরে আসেন। এখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধু আলোচনার জন্য রাজি হলেও অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেননি । ১৬ই মার্চ থেকে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা শুরু হয়। এরপর ২২শে মার্চ হঠাৎ জুলফিকার আলী ভূট্টো ঢাকা আসেন এবং আলোচনার অংশ নেন। এর মধ্যে ১৯শে মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা জয়দেবপুরে নিরীহ মানুষের ওপর হামলা চালালে এর প্রভাব মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনাকে প্রভাবিত করে। মূলত এসময় আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে এদেশের ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকার বদলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৪শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্স সংকট সমাধানের শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু আলোচনা অসমাপ্ত রেখে ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার আগে তিনি সামরিক ৰাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিয়ে যান।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বাঙালির তথা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়, যা 'কালরাত্রি' নামে পরিচিত। সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরন্ত্র, নিরীহ, স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনগণের ওপর হামলা করে এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তান তাদের এ অভিযানের নাম দের অপারেশন সার্চলাইট'।
১৮ই মার্চ টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী 'অপারেশন সার্চলাইট' বা বাঙালির ওপর নৃশংস হত্যাকাও পরিচালনার নীলনকশা তৈরি করেন। ১৯শে মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ শুরু হয়। ২০শে মার্চ সরকার অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ জারি করে। ঐ দিন জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পিরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। এ সময় প্রতিদিন ৬টি থেকে ১৭টি পর্যন্ত পিআইএ ফ্লাইট বোয়িং ৭৩৭ বিমান সৈন্য ও রসদ নিয়ে ঢাকা আসে এবং অসংখ্য সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই হয়ে আসা জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষা করে। ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এম ভি সোয়াড জাহাজ থেকে অস্ত্র ও রসদ খালাস গুৰু হয় । সব প্রস্তুতি শেষে ২৫শে মার্চ গণহত্যার জন্য বেছে নেয়া হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ঢাকা শহরে অপারেশন সার্চলাইটের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আক্রমণ শুরু হয় গভীর রাতে। জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলে চালানো হয় হত্যা ও পাশবিক নির্যাতন। এছাড়া পিলখানা, ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইলে আক্রমণ করে নির্বিচার হত্যা চালানো হয়। একইভাবে গণহত্যা চলেছিল পুরনো ঢাকায়, কচুক্ষেত, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে, রায়েরবাজার, গণকটুলি, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান প্রভৃতি স্থানে। ঢাকার ন্যায় দেশের অন্যান্য শহরেও পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে।
গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ জন্যই ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। ২৫শে মার্চ রাত ১২ টার পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেন। বাংলাদেশের সকল স্থানে তদানীন্তন ইপিআর এর ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে ঘোষণাটি প্রচার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল ইংরেজি ভাষায়, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঘোষণার বিষয়টি বুঝতে পারেন। ঘোষণার বাংলা অনুবাদটি নিম্নরূপ:
“ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহবান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।”
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ২৬শে মার্চ দুপুরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রামের বেতারকেন্দ্র থেকে একবার এবং সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে দ্বিতীয়বার প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এর প্রতি বাঙালি সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সমর্থন ও অংশগ্রহণের খবরে স্বাধীনতাকামী জনগণ উজ্জীবিত হয়। উল্লেখ্য, ২৭ ও ২৮শে মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের গুরুত্ব বিবেচনা করে মেজর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে উক্ত কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করান।
'অপারেশন সার্চ লাইট' এর নির্মম পরিকল্পনা মোতাবেক নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর আক্রমণের পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার এড়িয়ে কেন আত্মগোপনে যাননি, তা নিয়ে নানা বক্তব্য আছে । কারণ, বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন ২৫শে মার্চের পাকিস্তানী আক্রমণ সম্পর্কে । কিন্তু কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে। পাকিস্তানি আক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর আশেপাশের সকল সহকর্মীকে তাৎক্ষণিকভাবে শহর ছাড়তে এবং তোফায়েল, রাজ্জাক ও অন্যান্য তরুণ নেতাদের বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ে গ্রামের দিকে চলে যাবার নির্দেশ দেন।
রাজনৈতিক সহকর্মীদের আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে বাসায় অবস্থানের কারণ বঙ্গবন্ধু ব্যাখ্যা করেছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমাণ্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ওরা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপোসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে । আমি বাড়ি থেকে বেরুনো, না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি স্থির করলাম : আমি মরি, তাও ভাল, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক। ...আমি ইচ্ছা করলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করবো। মৃত্যুবরণ করবো। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল: তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল।”
আবার সহকর্মীদের আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে আত্মগোপনে না যাওয়ার কারণ ২৫শে মার্চ রাতেই তিনি সহকর্মীদের নিকট ব্যাখ্যা করেছেন বলে মওদুদ আহমদ তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মওদুদের ভাষ্য মতে, শেখ মুজিব বলেন, আমাকে সবাই চেনে। আমাকে গ্রেফতার করা হলে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বিষয়টি গ্রহণ করবে। কিন্তু তোমাদের কেউ চেনে না। কাজেই তোমাদের অবশ্যই পালাতে হবে।' জে. এন. দীক্ষিতের মতে, শেখ মুজিব ভেবেছিলেন তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। অন্য কারণ হলো, মুজিব আত্মগোপন করলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর জনগণের ওপর আরও ভয়াবহ অত্যাচারে মেতে উঠবে। গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২৫শে মার্চে সারাদিন বঙ্গবন্ধু প্রচুর লোকজনের সাথে আলাপ করেন। অনেকে তাঁকে বাসা ছেড়ে যেতে বলেন। প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “যখন একটি জাতির নেতা পালিয়ে যায় তখন ঐ জাতির মনোবল ভেঙে যায়” । সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু নিজে কখনো কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন বা দাবি আদায়ে পিছপা হননি বা পালিয়েও যাননি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী হিসেবে কারাবরণ করাকেই তিনি যৌক্তিক বিবেচনা করেন।
উল্লিখিত সব তথ্য ও ব্যাখ্যা সঠিক ও যৌক্তিক হিসেবে গ্রহণ করে বলা যায়-রাজনৈতিক সহকর্মী ও বাঙালি জনগণের ওপর বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। তিনি নিশ্চিত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলন যে পর্যায়ে এসেছে তাতে তাঁর নিজের অনুপস্থিতিতেও সহকর্মীরা এই আন্দোলনকে সফলতায় নিয়ে যেতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে আহমেদ সালিম তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “ভুট্টো এবিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, মুজিব শহিদের মৃত্যু বেছে নিয়েছেন এবং তাঁর কবরের ওপর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে বলে আশা করেছেন।”
শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা হেফাজতে নেবার পর ১০ই এপ্রিল ঘোষণা করা হলো-শেখ মুজিব তাদের হাতে বন্দি । মূলত ওই ঘোষণা এবং করাচি বিমানবন্দরে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরই বাঙালিরা তাঁর বেঁচে থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হন এবং স্বস্তিবোধ করতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের তিনদিন পরে ২৯শে মার্চ বিমানযোগে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং লায়ালপুর (বর্তমান ফয়সালাবাদ) জেলে আটক রাখা হয়।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হলে বিচ্ছিন্নভাবে বাঙালিরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এ সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় । শপথ অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নাম অনুসারে বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ করা হয় মুজিবনগর এবং সরকারও পরিচিত হয় মুজিবনগর সরকার নামে । এ সরকার গঠনের মাত্র দুই ঘণ্টা পর পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান মুজিবনগরে বোমাবর্ষণ করে এবং মেহেরপুর দখল করে নেয় । তখন মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত হয় ।
রাষ্ট্রপতি |
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান |
উপ-রাষ্ট্রপতি |
সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ) |
প্রধানমন্ত্রী |
তাজউদ্দীন আহমদ |
অর্থমন্ত্রী |
ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী |
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কৃষিমন্ত্ৰী |
এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান |
পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী |
খন্দকার মোশতাক আহমদ |
প্রধান সেনাপতি |
কর্নেল (অব.) এম.এ.জি ওসমানী |
চিফ অব স্টাফ |
লে. কর্নেল (অব.) আবদুর রব |
ডেপুটি চিফ অব স্টাফ |
গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার |
১৯৭০-৭১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য দ্বারা মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয় । মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা ছিল এ সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ।
বাঙালি কর্মকর্তাদের নিয়ে সরকার প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করেন। এগুলো হচ্ছে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ-শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়, সাধারণ প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, যুব ও অভ্যর্থনা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ বোর্ড ইত্যাদি। মুজিবনগর সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে (কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, স্টকহোম) বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন করে। এসব মিশন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিশেষ দূত নিয়োগ দেয় । তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমতসৃষ্টি ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন আদায়ের জন্য কাজ করেন। ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক, বেসামরিক জনগণকে নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । ১০ই এপ্রিল সরকার ৪টি সামরিক জোনে বাংলাদেশকে ভাগ করে ৪ জন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করে । ১১ই এপ্রিল তা পুনর্গঠিত করে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় । এ ছাড়া বেশ কিছু সাব-সেক্টর এবং তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠিত হয়। এসব সেক্টরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, সেনাসদস্য, পুলিশ, ইপিআর, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যগণ যোগদান করেন । প্রতিটি সেক্টরেই নিয়মিত সেনা, গেরিলা ও সাধারণ যোদ্ধা ছিল। এরা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিফৌজ নামে পরিচিত ছিল । এসব বাহিনীতে দেশের ছাত্র, যুবক, নারী, কৃষক, রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিল । ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে যোদ্ধাগণ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সামরিক ছাউনি বা আস্তানায় হামলা চালায় । মুক্তিযুদ্ধে সরকারের অধীন বিভিন্ন বাহিনী ছাড়াও বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছিল ।
এসব সংগঠন স্থানীয়ভাবে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল । যেমন : টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনী, মাগুরার আকবর বাহিনী ইত্যাদির কথা স্মরণীয় হয়ে আছে । ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে দেশকে পাকিস্তানিদের দখলমুক্ত করার জন্য রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছেন, অনেকে আহত হয়েছেন, অনেকে দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন
২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল । ‘অপারেশন সার্চলাইট' নামে ঢাকায় যে গণহত্যা শুরু করে, এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এদেশের ছাত্রসমাজ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় । কারণ, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বিশ্বাস করত, পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন-সংগ্রামের পেছনে হিন্দুদের হাত রয়েছে, আর এদের ইন্ধন যোগায় ভারত ।
যদিও ২৫শে মার্চ ‘জিরো আওয়ারে' পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু করার কথা, তথাপি রাত সাড়ে এগারোটার দিকে সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায় পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যে। ঢাকাসহ সারা দেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং বহু শিক্ষকের আবাসিক ভবনে তারা আক্রমণ করে অনেককে হত্যা করে । রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে, পিলখানার ইপিআর হেডকোয়াটার্সসহ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ট্যাংক, কামান, মেশিনগান দিয়ে হামলা চালায়। শুরু হয় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ জনতা ঢাকার রাজপথে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করে । অসীম সাহস নিয়ে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে । কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী অনায়াসে ভেঙে ফেলে এই প্রতিরোধ ।
পুরনো ঢাকার নবাবপুর, তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজার এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষোভ যে বেশি ছিল তা সেখানকার নিষ্ঠুর গণহত্যা, নির্যাতন আর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বোঝা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে হিন্দুমাত্রই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং হিন্দুরা হচ্ছে ‘পবিত্র’ পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ । আর এদের পেছনে রয়েছে ভারতের আনুকূল্য ও সমর্থন । এমনি অন্ধবিশ্বাস থেকে গণহত্যা আর নারী নির্যাতনের ভিতর দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র হিন্দু বিদ্বেষ, আক্রোশ আর ভয়ংকর ঘৃণার প্রকাশ ঘটে । আকস্মিক আক্রমণে নিরীহ, অসহায় নগরবাসী আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পায়নি ।
সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর রোষানলে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্ৰ দেব, ড. মুনীরুজ্জামানসহ অনেক শিক্ষক এবং শত শত ছাত্রকে হত্যা করা হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা দুই দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে মারা যান । পুরনো ঢাকায় বিশেষ করে শাঁখারীবাজার, তাঁতি বাজারের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার অবস্থা ছিল ভয়াবহ । ঢাকাবাসী দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তাদের জন্য কী বর্বর, নৃশংস, পৈশাচিক আক্রমণ অপেক্ষা করছে। ঢাকা শহর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। চারদিকে কেবল আর্তনাদ, অসহায় মানুষের হাহাকার আর লাশ ।
কেবল রাজধানী ঢাকা শহর নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে যায় পাকিস্তানি বাহিনী । মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। দুই লাখের অধিক মা-বোন পাকিস্তানিদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল । পরিকল্পিতভাবে এদেশকে মেধাশূন্য করার জন্য তারা বরেণ্য সাহিত্যিক, শিল্পী, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীকে নির্মমভাবে হত্যা করে ।
নির্যাতন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ইত্যাদি অপরাধ কর্মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও কথিত শান্তি কমিটি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগী এদেশীয় ব্যক্তিবর্গ এককথায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত। প্রধানত, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের সমর্থকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করে । এই দলগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধেও অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা করেছে ।
রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছিল পাকিস্তান সরকার । ১৯৭১ সালের জুন মাসে লে. জেনারেল টিক্কা খান 'পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স' জারি করেন । শুরুতে আনসার, মুজাহিদদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয় । পরে পাকিস্তানপন্থী অনেকে এই বাহিনীতে যোগ দেয় । এই বাহিনী গঠনে জেনারেল নিয়াজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । রাজাকারদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল এক সপ্তাহ । রাজাকারদের ট্রেনিং দিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী । দখলদার বাহিনীর দোসর হিসেবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে । রাজাকার বাহিনী ছাড়াও আলবদর নামে আরও একটি ভয়ঙ্কর বাহিনী ছিল । জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয় । অন্যান্য ইসলামী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে আলশামস বাহিনী গঠিত হয় । বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান দায়িত্ব ছিল আলবদর বাহিনীর ওপর । তাই এই বাহিনী ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও হিংস্র প্রকৃতির। আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির (মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) মতিউর রহমান নিজামী। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় প্রথম যে সংগঠনের জন্ম হয় তা হলো 'শান্তি কমিটি'। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠন করা হয় । পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং জামায়াতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ওলামায়ে ইসলাম, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের উৎসাহ ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শান্তি কমিটি বিস্তার লাভ করে । অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যায় এই সংগঠন দখলদার বাহিনীর বিশ্বস্ত সহচর ছিল । কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা খয়েরুদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ‘ঢাকা নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হয় । এই কমিটিতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম, মৌলভি ফরিদ আহম্মদ, এএসএম সোলায়মানসহ অনেকে ছিল ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘পোড়ামাটি নীতি' অনুযায়ী বাংলাদেশের সব সম্পদ ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে । যে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, ঘর-বাড়ি, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির কোনো কিছুই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তাদের লক্ষ্য ছিল এই ভূখণ্ডের মানুষদের হত্যা করে কেবল ভূমির দখল নেওয়া। পাকিস্তানি বাহিনীকে এসব মানবতাবিরোধী অপকর্মে সহায়তা করেছে এদেশীয় কিছু দালাল চক্র ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই সৃষ্টি হয় শরণার্থী সমস্যা। ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হলে প্রাণভয়ে ও নিরাপত্তার সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন পথে পাশের দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রাম ও শহরগুলোতে আশ্রয় নেয়। শরণার্থীদের বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। বাকিরা ত্রিপুরা ও আসামে। ১৯৭১ সালের ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন। শরণার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু । শরণার্থী শিবিরগুলোতে ছিল খাদ্য, পানীয় জল, ওষুধপত্রের স্বল্পতা। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান শরণার্থী সমস্যাকে জাতিসংঘের সামনে সমসাময়িক কালে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। বস্তুত, জাতিসংঘ সৃষ্টির পর বাংলাদেশ সংকটে জাতিসংঘ সবচেয়ে বড় মানবিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। শরণার্থী ইস্যুর ব্যাপকতাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সহানুভূতির জন্ম দিয়েছিল। শরণার্থীদের নিয়ে সরকারি পর্যায়ে ভারতের নীতির প্রধান দুটি দিক ছিল। প্রথমতঃ মানবিক কারণ, দ্বিতীয়তঃ জাতীয় স্বার্থ। অবশ্য ভারতের সুশীল সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল একান্তই মানবিক।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৬ই মে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় বেশ কিছু শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ১৮ই মে রানীক্ষেতে এক জনসভায় ভাষণদানকালে ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা অনুধাবনের জন্য বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। ভারত শরণার্থীদের নিজে যেমন সাহায্য করেছে, তেমনি বহির্বিশ্বকেও সাহায্য করতে আহবান জানিয়েছিল। জুন ১৯৭১ পর্যন্ত জাতিসংঘ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত ও প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের ইতিহাসে এটা ছিল আকাশপথে সবচেয়ে বৃহৎ সাহায্য। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোও সাহায্য পাঠান। ভারত তার নিজস্ব কোষাগার থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করে। এজন্য ভারতীয় জনগণকে ১৯৭১-৭২ সালে অতিরিক্ত কর দিতে হয়। ভারতে শরণার্থীদের অস্বাভাবিক আগমণে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠে। শরণার্থী শিবিরগুলো পূর্ণ হওয়ায় অন্যরা খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, ফুটপাতে ও রেলস্টেশনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ত্রিপুরায় ১৪ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নেয়, যা গোটা ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার সমান ছিল। সেখানে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। সন্তানদের চরম ক্ষতি স্বীকার করেও অভিভাবকেরা শরণার্থীদের আশ্রয়হীন করতে চাননি। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্ৰ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। বাম রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলেও একটি অংশ বিরুদ্ধে ছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো কেবল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাই নয়, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছে । মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল হলো আওয়ামী লীগ । বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট যোগ্যতা, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে ।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সমমনা বাম রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ-ভাসানী), মণি সিং (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি), মনোরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস), অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ (ন্যাপ-মোজাফ্ফর) এবং আওয়ামী লীগ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ । তবে পিকিংপন্থী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মতিন-আলাউদ্দিন) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে । পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা এদেশের জনগণকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করেছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তির সংগ্রামে শামিল হয় ।
ছাত্রছাত্রী:
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল ছাত্র। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ছাত্ররা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাশাপাশি স্কুলপড়ুয়া কিশোররা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যায় । মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ সরকার ছাত্র-যুবকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের সংস্থান করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্র তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ আর হালকা অস্ত্র নিয়ে অসীম সাহস, মনোবল আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিসেনার দল ।
কৃষক:
মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের অবদান ছিল অত্যন্ত গৌরবময়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। শত্রুর বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রতিটি আক্রমণে তাঁরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাব তাঁদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। একটাই লক্ষ্য- যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।
নারী:
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম থেকেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তাতে নারীদের বিশেষ করে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। দেশকে স্বাধীন করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। নারীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মিছিল, মিটিং ও পণসমাবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন । যুদ্ধের ৯ মাসে কয়েক লক্ষ মা-বোন পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের শিকার হন। তাঁদেরকে বঙ্গবন্ধু কন্যার মতো মমতায় সম্বোধন করেছেন 'বীরাঙ্গনা' বলে। এর বাইরে বিশালসংখ্যক নারী মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, সেবা দিয়ে, নানাভাবে সহায়তা করেছেন। এমনকি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের দৃষ্টান্তও কম নয় । মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ দুইজন নারী ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব অর্জন করেন । একজন তারামন বিবি, অন্যজন ডাক্তার সিতারা বেগম । সারা দেশে আরও অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবেলা করেছেন ।
গণমাধ্যম:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম । সংবাদপত্র ও স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে । ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেন । পরে এটি মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় । স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র সংবাদ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, রণাঙ্গনের নানা ঘটনা ইত্যাদি দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করে; মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়ে বিজয়ের পথ সুগম করে । এছাড়া মুজিবনগর সরকারের প্রচার সেলের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে ।
প্রবাসী বাঙালি:
প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন । বিভিন্ন দেশে তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন । বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে পার্লামেন্ট সদস্যদের নিকট ছুটে গিয়েছেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছেন, পাকিস্তানকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহ না করতে আবেদন করেছেন । এক্ষেত্রে, ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে তাঁরা কাজ করেছেন ।
শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী:
মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ । তথাপি, যুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিক- বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন সংস্কৃতি কর্মীর অবদান ছিল প্রশংসনীয় । এমনকি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন । পত্রপত্রিকায় লেখা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পাঠ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, কবিতা পাঠ, নাটক, কথিকা, এম আর আকতার মুকুলের অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘চরমপত্র' এবং ‘জল্লাদের দরবার' ইত্যাদি অনুষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে । এসব অনুষ্ঠান রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক ও নৈতিক বল ধরে রাখতে সহায়তা করেছে, সাহস জুগিয়েছে, জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় করেছে। সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন আহমদসহ অগণিত গুণিজনকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে এদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে, হয়েছে স্বাধীন ।
জনসাধারণ:
সাধারণ জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বাধীনতার প্রতি ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষার ফলেই মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কিছুসংখ্যক দোসর ব্যতীত সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, শত্রুর অবস্থান ও চলাচলের তথ্য দিয়েছে, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করেছে, সেবা দিয়েছে ও খবরাখবর সরবরাহ করেছে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণও অংশগ্রহণ করে। অনেকে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহিদের মধ্যে সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছিল অধিক । তাঁদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীন মানচিত্র, লাল-সবুজ পতাকা ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন । নানা অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করেছেন । রাজনীতিবিদগণ স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবন বাজি রেখে রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে গেছেন ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তাঁর সারা জীবনের কর্মকাণ্ড,আন্দোলন-সংগ্রাম নিবেদিত হয়েছে বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে । ১৯৪৮ সালের ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক সম্মেলনের মাধ্যমে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠন করা হয়। সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক এবং যুগ্ম সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমদ। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে দলের নাম 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ' করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই দলটি বাঙালিদের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় ।
'৪৮ ও '৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীদের মধ্যে অন্যতম। কী সংসদ, কী রাজপথ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তাঁর কণ্ঠ ছিল সর্বদা সোচ্চার । ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা' কর্মসূচি পেশ ও ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতা অর্জনে একচ্ছত্র ভূমিকা পালন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।
পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের মধ্যে ১২ বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন । ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লে ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালের প্রথম প্রহরে (২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর) তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । সংগ্রামের পথ ধরে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন । তাঁর নামেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় । তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি । তাঁর বলিষ্ঠ ও আপোসহীন নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন স্বাধীনতার মহানায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ।
তাজউদ্দীন আহমদ: মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহচর। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত মুজিবনগর সরকারের (১০ই এপ্রিল, ১৯৭১) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এই মহান নেতা ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল তিনি বেতার ভাষণে মুজিবনগর সরকার গঠনের কথা প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তিনি সফলভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন । মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত উপদেষ্টা কমিটির তিনি আহ্বায়ক ছিলেন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম: সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা । তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন । বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও সফল করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান । সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক ও পরিচালক ।
ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী: ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধকালীন খাদ্য, বস্ত্র, অস্ত্র প্রশিক্ষণের অর্থের সংস্থান প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল । তিনি সফলভাবে এ দায়িত্ব পালন করেন ।
এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান: এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান আওয়ামী লীগের আর একজন শীর্ষ নেতা । মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী ছিলেন । সে সময়ে তিনি ভারতে আশ্রয় নেয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ সংগ্রহ, ত্রাণশিবিরে ত্রাণ বিতরণ এবং পরবর্তী সময়ে শরণার্থীদের পুনর্বাসন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন করেন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অবদান অপরিসীম ।
অন্য নেতৃবৃন্দ: অন্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য । তিনি ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা (১৯৬৮-৬৯) থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে গড়ে ওঠা আন্দোলন ও '৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থান করে বিভিন্ন দেশের প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন আদায় ও পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান । এছাড়া অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ (ন্যাপ-মোজাফ্ফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মণি সিংহ মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য গঠিত ‘উপদেষ্টা কমিটি'তে এই তিন নেতা সদস্য ছিলেন ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয় । পাকিস্তানি বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধী এদেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হয়। বিভিন্ন দেশ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে । ২৫শে মার্চের কালরাত্রি এবং পরবর্তী সময়ের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বিশ্বজনমত সোচ্চার হয়ে ওঠে । গোটা বিশ্বের জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন জানায় ।
ভারতের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সমর্থন জানায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত । ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাত্রির বীভৎস হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী ৯ মাস ধরে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী যে নারকীয় গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, ভারত তা বিশ্ববাসীর নিকট সার্থকভাবে তুলে ধরে । বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত । তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত করে তোলেন তাঁর নিরলস কর্ম তৎপরতার ভেতর দিয়ে।
ভারতের জনগণ ও সরকার প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানের আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে ‘যৌথ কমান্ড' গঠন করে । ভুটান ও ভারত ৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে । ভারতের বহু সৈন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারান।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পর সর্বাধিক অবদান রাখে অধুনা লুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) । পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আহ্বান জানান। তিনি ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যও বলেন। সোভিয়েত পত্রপত্রিকা, প্রচার মাধ্যমগুলো বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের কাহিনি ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি প্রচার করে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে সহায়তা করে । জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘ভেটো' (বিরোধিতা করা) প্রদান করে বাতিল করে দেয় । সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে কিউবা, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানিসহ তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন জানায় ।
গ্রেট ব্রিটেন,পশ্চিমা বিশ্ব ও অন্যান্য দেশের ভূমিকা: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ব্রিটেনের প্রচার মাধ্যম বিশেষ করে বিবিসি এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন, প্রতিরোধ, বাঙালিদের সংগ্রাম, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের করুণ অবস্থা, পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশ্ব জনমতকে জাগ্রত করে তোলে । উল্লেখ্য, লন্ডন ছিল বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারের প্রধান কেন্দ্র । ব্রিটেন ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও কানাডার প্রচার মাধ্যমগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করে । ইরাক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জানায় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, প্রচার মাধ্যম, কংগ্রেসের অনেক সদস্য এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার ছিল; তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, চীন এবং ইরান ও সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। তবে মার্কিন শিল্পী, সাহিত্যিক এবং অনেক রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন। পণ্ডিত রবি শংকরের উদ্যোগে আয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' অনুষ্ঠানে ৪০,০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানসহ বিশ্বখ্যাত শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানটির মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ জোগানের ব্যবস্থা হয়।
জাতিসংঘের ভূমিকা : বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান যখন বাঙালি নিধনে তৎপর, তখন জাতিসংঘ বলতে গেলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে । নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি ।
বিশ্ব ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা । বাংলাদেশ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে প্রথম দেশ, যে দেশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে । মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত আমাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে । বিশেষভাবে ১৯৭১ সালের ২১শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিলে ‘যৌথ কমান্ড’ গঠন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । পাকিস্তান ৩রা ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করলে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় । ৬-১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতের সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয় ।
যৌথ বাহিনীর সুপরিকল্পিত আক্রমণে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পূর্বেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নৈতিক পরাজয় ঘটে । অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্যসহ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন । বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার । ত্রিশ লক্ষ শহিদ, কয়েক লক্ষ মা-বোনের সীমাহীন কষ্ট, নিপীড়ন আর ত্যাগের বিনিময়ে এই মহান স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে । বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ।
আমরা জানি, আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। তবে, সংবিধান অনুযায়ী নাম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ । এই নামেরও একটা ইতিহাস আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের নামের সঙ্গে ভূখণ্ডের সীমানার সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । আর নানা সময়ে এর সীমানারও বদল হয়েছে ।
প্রাচীনকালে আমাদের বাংলাদেশ নানা জনপদে বিভক্ত ছিল । তা এই গ্রন্থের শুরুর দিকে আলোচনা করা হয়েছে । মহাভারত এবং গ্রিক ঐতিহাসিক টলেমির লেখায় ‘বাংলা' নামের উল্লেখ পাওয়া যায় । তার অনেক পরে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম বাংলার তিনটি প্রধান কেন্দ্র লখনৌতি বা লক্ষণাবতী (গৌড়), সাতগাঁও (রাঢ়) ও সোনারগাঁ (বঙ্গ)-কে একত্র করে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এর স্বাধীনতা ২০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল । ইলিয়াস শাহের উপাধি ছিল 'শাহ-ই-বাঙ্গালাহ', 'শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’, ‘সুলতান-ই- বাঙ্গালাহ'। আর তখন থেকে সমগ্র বাংলা অঞ্চল ‘বাঙ্গালাহ' নামে পরিচিতি লাভ করে । মুঘল আমলে সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলার পরিচয় হয় ‘সুবাহ বাংলা' নামে । তবে, ইউরোপীয়রা বিশেষভাবে পর্তুগিজরা ‘বেঙ্গালা' নামে অভিহিত করেছে এই অঞ্চলকে এবং ইংরেজরা বলত ‘বেঙ্গল' ।
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বাংলা নামে পৃথক প্রদেশ করা হয় । বাংলার অধীনে ছিল বিহার, উড়িষ্যা এবং ছোট নাগপুর । পরে ১৯০৫ সালে বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের আসাম নিয়ে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে নতুন প্রদেশ গঠন করা হয় । আন্দোলনের মুখে ৬ বছর পরে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে ইংরেজ সরকার । ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান হলে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে আর পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় । পাকিস্তান আমলেও আজকের বাংলাদেশ ‘পূর্ববঙ্গ' নামেই পরিচিত ছিল । পাকিস্তান সরকার পূর্ববঙ্গ পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করলে বঙ্গবন্ধু এর বিরোধিতা করেন । বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলা নামের দীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে । তাই বাংলার নাম পরিবর্তনের পূর্বে গণভোটের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের মতামত গ্রহণ করতে হবে । ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আমাদের অহংকার আর গৌরবের প্রতীক । অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে লাল-সবুজের এই পতাকা এদেশের জনগণ অর্জন করেছে । জাতীয় পতাকার সবুজ আয়তক্ষেত্র বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির প্রতীক, আর বৃত্তের লাল রং মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী শহিদদের রক্তের প্ৰতীক । কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পতাকায় লাল বৃত্তে সোনালি রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত ছিল। মানচিত্র খচিত পতাকার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল এই ভূখণ্ডে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে । মানচিত্র খচিত এই পতাকা আমাদের সংগঠিত, একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছে। ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে জাতীয় পতাকা তৈরির নকশা করা হয়। এই পতাকা তৈরির সহযোগী হিসেবে ছিলেন আ.স.ম. আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু, শিব নারায়ণ দাস ও কামরুল আলম খান খসরু। ১৯৭০ সালের ৬ই জুন গভীর রাতে অত্যন্ত গোপনভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১১৬ নং কক্ষে পতাকা তৈরির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। বলাকা বিল্ডিংয়ে তৃতীয় তলায় অবস্থিত পাক ফ্যাশন টেইলার্সে জাতীয় পতাকাটি সেলাই করা হয়।
১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চে যখন উত্তাল সারা দেশ, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পশ্চিম দিকের গেটে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ২রা মার্চ, ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো উত্তোলন করেন ছাত্রনেতা আ. স. ম. আবদুর রব। এ যেন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যানের শামিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ইতোমধ্যে সারা দেশে শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে ঘটে গেল অভাবনীয় ঘটনা । ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হলো। বহু বাড়ি-ঘরে ওড়ানো হলো বাংলাদেশের পতাকা। পাকিস্তানের প্রত্যাখ্যাত পতাকা আর ফিরে আসতে পারেনি। ত্রিশ লক্ষ শহিদ জীবন দিয়েছেন বাংলাদেশের পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে পটুয়া কামরুল হাসানকে দায়িত্ব দেন জাতীয় পতাকার নকশা চূড়ান্ত করার। পটুয়া কামরুল হাসানের হাতেই আমাদের জাতীয় পতাকা বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
জাতীয় পতাকা একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। জাতীয় পতাকার সম্মানের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্মান-মর্যাদা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই পতাকার সম্মান রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য ।
জাতীয় সংগীতের ইতিহাস:
"আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' সংগীতটি আমাদের জাতীয় সংগীত। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সংগীত রচনা করেন। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে স্বদেশী আন্দোলনের সময় এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। গানটি ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি ঢাকায় এক বিশাল জনসভায় এবং পরে ৩রা মার্চ ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত জনসভায় পুনরায় গাওয়া হয় । ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের প্রাক্কালে গানটি গাওয়া হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার এই গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হয় । স্বাধীনতার পর সাংবিধানিকভাবে (অনুচ্ছেদ ৪.১) ‘আমার সোনার বাংলা' গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে ঘোষিত হয় । গানের প্রথম ১০ লাইন কণ্ঠসংগীত এবং প্রথম ৪ লাইন যন্ত্রসংগীত হিসেবে পরিবেশনের বিধান রাখা হয় ।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত:
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো- কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে ।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে-
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি॥
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের আনুষ্ঠানিকতা:
ক. স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহিদ দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলোতে সম্পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে ।
খ. রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী যেসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন, সেসব অনুষ্ঠানে তাঁদের আগমন ও প্রস্থানের সময় সম্পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে ।
গ. কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মানে গার্ড অব অনার প্রদানকালে রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন প্রদানের সময় পূর্ণ জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে । এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রথমে অতিথি দেশের জাতীয় সংগীত এবং পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে । কিন্তু অতিথি সরকারপ্রধান হলে কেবল প্রথম চার লাইন পরিবেশিত হবে ।
ঘ. বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাসগুলোর সরকারি অনুষ্ঠানে কেবল প্রথম চার লাইন পরিবেশিত হবে । অনুষ্ঠানে প্রথমে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং পরে সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে ।
ঙ. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও কূটনৈতিক মিশন আয়োজিত অন্যান্য অনুষ্ঠান, বিশেষ অনুষ্ঠান ও জনসভায় অনুমোদিত বিধি অনুযায়ী জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে ।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ: মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নাম না-জানা শহিদের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এটি ঢাকা শহর থেকে ৩৫ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে সাভারে অবস্থিত। স্থপতি মঈনুল হোসেনের নকশা অনুযায়ী জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সাতটি জোড়া ত্রিভুজাকার দেয়ালের মাধ্যমে ছোট থেকে বড় হয়ে ধাপে ধাপে সৌধটি ১৫০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছে । সমগ্র স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে । স্মৃতিস্তম্ভের মূল বেদিতে যেতে হলে বেশ দীর্ঘ উঁচু-নিচু পথ, পেভমেন্ট ও একটি কৃত্রিম লেকের উপর নির্মিত সেতু পার হতে হয় । এই সবকিছুই আসলে আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক । পাশেই রয়েছে গণকবর, যাঁদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে এদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। মূল স্মৃতিসৌধে সাত জোড়া দেয়াল, মূলত বাঙালির গৌরবময় সংগ্রামের প্রতীক। এই রাজনৈতিক ঘটনাগুলো হলো ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সালের মধ্যেই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস নিহিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনার ফলেই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আর জাতীয় স্মৃতিসৌধ বারবার আমাদের সেই মহান শহিদদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ১৯৭২ সালের জাতীয় স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ শুরু হয় । ১৯৮২ সালে তিনটি পর্যায়ে তা সম্পন্ন হয়। বাঙালির অহংকার, গৌরব আর মর্যাদার প্রতীক এই স্মৃতিসৌধ।
অপরাজেয় বাংলা: বাঙালির প্রতিবাদী মনোভাব ও মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াকু চেতনার মূর্ত প্রতীক অপরাজেয় বাংলা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন চত্বরে ৬ ফুট উঁচু বেদির ওপর নির্মিত । মূল ভাস্কর্যের উচ্চতা ১২ ফুট, গ্রন্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট । বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি সংগ্রামে ছাত্রদের গৌরবময় ত্যাগকে স্মরণীয় করার জন্য অপরাজেয় বাংলা নির্মাণ করা হয় । মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ এটি নির্মাণ করেন । ১৯৭৩-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ চলে । এই ভাস্কর্যে অসম সাহসী তিনজন তরুণ-তরুণী মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব অপূর্ব দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুইজন তরুণ রাইফেল হাতে শত্রুর মোকাবেলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আর ঔষধের ব্যাগ কাঁধে তরুণী মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। অপরাজেয় বাংলা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ:
মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী মুজিবনগর সরকারের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে (বর্তমানে জেলা) এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিসৌধে ২৪টি পৃথক ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল বৃত্তাকারে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সর্বশেষ উচ্চতায় স্থির হয়েছে। ২৪টি ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল হলো ২৪ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণের অধিকার আদায়ে ক্রমে সংগঠিত হয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে এদেশের জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ক্রমে সংগঠিত হয়েছে। একপর্যায়ে দৃঢ় মনোবল আর সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। কারণ এখানেই শপথ নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই স্মৃতিসৌধের স্থপতি ছিলেন তানভীর করিম ।
শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ: বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় অগণিত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মানবতাবিরোধী এই বর্বর কাজে সহায়তা করেছে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চূড়ান্ত পরাজয়ের দুই দিন পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। তাঁদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকার মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় । এর স্থপতি ছিলেন মোস্তফা আলী কুদ্দুস । ১৯৭২ সালে এই স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ শেষ হয় ।
শিখা চিরন্তন: মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহিদদের অমর স্মৃতি চির জাগরুক রাখার জন্য ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৯৭ সালের ২৬শে মার্চ শিখা চিরন্তন স্থাপিত হয় । ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে এই স্থান থেকেই ‘মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের' ডাক দিয়েছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন স্থাপন করা হয় ।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি: মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে অগণিত বধ্যভূমি ও গণকবর। তখন রায়েরবাজার এলাকাটি ছিল বেশ নিরিবিলি। জনবসতি খুব একটা চোখে পড়ত না। কালুশাহ পুকুরপাড় থেকে গোল মসজিদ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিলোমিটার। মার্চ মাস থেকেই রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। এখানে মানুষকে শুধু হত্যা করা হয়েছে তা নয়, অগণিত লাশ এনে ফেলা হয়েছে এই বধ্যভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এখানকার ইটখোলার রাস্তা দিয়ে লোকজন হাঁটাচলার সাহস করত না। ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। সেদিন এই বধ্যভূমির বিভিন্ন গর্ত থেকে প্রচুর গলিত ও বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়। এখানে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসকের লাশই অধিক ছিল। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে আলবদর ও রাজাকাররা প্রধান ভূমিকা পালন করে । রায়েরবাজারে উদ্ধারকৃত লাশগুলো এতটাই বিকৃত হয়ে পড়ে যে, পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। তবে যে কয়েকজনের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে, তাঁরা হলেন— অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ডা. ফজলে রাব্বী, চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী প্রমুখ ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: ১৯৯৬ সালের ২২ শে মার্চ ঢাকার সেগুনবাগিচায় একটি ভাড়া বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সূচনা ঘটে। পরবর্তীকালে ১৬ই এপ্রিল ২০১৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঢাকার আগারগাঁও-এ নিজ ভবনে স্থান্তরিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা। নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার ইতিহাস বিষয়ে সচেতন করে তোলা। ফলে তারা মাতৃভূমির জন্য গর্ব অনুভব করবে,মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হবে। পাশাপাশি উদার, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আটজন ট্রাস্টির উদ্যোগে ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের সাথে মানুষের সমর্থন ও সহায়তায় সুনিপুণভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
গণহত্যা জাদুঘর: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা-নির্যাতনের স্মৃতিকে জনমানসে তুলে ধরতে ২০১৪ সালে খুলনায় বেসরকারি উদ্যোগে সরকারি সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর', সংক্ষেপে যেটি ‘গণহত্যা জাদুঘর' নামে পরিচিত। এই গণহত্যা জাদুঘর দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র জাদুঘর যারা একাত্তরের নির্মমতার স্মৃতি সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও একাত্তরে সংগঠিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করে চলেছে। ১১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে এটি পরিচালিত হয়। একাত্তরের গণহত্যায় শহিদদের নানা স্মৃতি স্মারক -এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ গণহত্যা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। জাদুঘরের দেয়ালজুড়ে একাত্তরের আলোকচিত্র আর শিল্পকর্মে ফুটে উঠেছে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ, নির্যাতন আর গণহত্যার নির্মমতা। একাত্তরের ভয়াবহতা ও নির্মমতার চিহ্ন দেখে শিউরে ওঠেন জাদুঘর পরিদর্শনে আসা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ দেশি ও বিদেশি পরিদর্শকবৃন্দ।
আরও দেখুন...